বৌদ্ধ তীর্থস্থান

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - | NCTB BOOK
3

দশম অধ্যায় বৌদ্ধ তীর্থস্থান

পূর্বের শ্রেণিতে আমরা বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জেনেছি। তীর্থস্থান সকল ধর্মের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। প্রত্যেক ধর্মের তীর্থস্থান রয়েছে। বৌদ্ধদেরও অনেক তীর্থস্থান আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব তীর্থস্থান অবস্থিত। তবে অধিকাংশ তীর্থস্থান রয়েছে ভারতে। তীর্থস্থান দর্শন পুণ্যের কাজ। বৌদ্ধরা পুণ্য অর্জনের জন্য তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করেন। এ অধ্যায়ে চারি মহাতীর্থস্থান এবং তাদের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে পড়ব । এ অধ্যায় শেষে আমরা-

* চারি মহাতীর্থস্থানের বর্ণনা দিতে পারব;

* চারি মহাতীর্থস্থানের ধর্মীয় ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব ।

পাঠ : ১

চারি মহাতীর্থস্থান পরিচিতি

খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে গৌতমবুদ্ধ বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর সর্বপ্রাণীর কল্যাণের জন্য বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করে তিনি ধর্ম প্রচার করেছেন। গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থান তীর্থস্থানের মর্যাদা লাভ করে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত তীর্থস্থানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ, কুশিনগর, রাজগৃহ, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, নালন্দা, বৈশালী, কোশাম্বী ইত্যাদি । এসব স্থানে বুদ্ধ অনেক মূল্যবান সময় অতিবাহিত করেছেন। অনেকবার বর্ষাবাস উদ্‌যাপন করেছেন। অনেক ধর্মোপদেশ প্রদান করেছেন। বৌদ্ধধর্মের অনুসারী এবং পৃষ্ঠপোষক রাজা ও মহারাজারা বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এসব স্থানে বিহার, সঙ্ঘারাম, চৈত্য, স্তম্ভ ইত্যাদি নির্মাণ করেছেন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের জীবনের চারটি প্রধান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল চারটি স্থানে। যেমন, তিনি জনুগ্রহণ করেন নেপালের লুম্বিনী কাননে । বুদ্ধের সময়কালে স্থানটি কোশল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন বুদ্ধগয়ায় । বুদ্ধের সময়কালে স্থানটি মগধ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বুদ্ধত্ব লাভ করার পর বুদ্ধ তাঁর নবলব্ধ ধর্ম প্রথম প্রচার করেন সারনাথে। বুদ্ধের সময়কালে সারনাথ কাশী রাজ্যের অন্তর্গত ছিল তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন কুশীনগরে। বুদ্ধের সময়কালে স্থানটি মল্ল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বুদ্ধের জীবনের চারটি প্রধান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে এ চারটি স্থানকে মহাতীর্থস্থান বলে। বৌদ্ধরা জীবনে অন্তত পক্ষে একবার হলেও চারি মহাতীর্থস্থান দর্শন করতে চেষ্টা করেন।

অনুশীলনমূলক কাজ

চারি মহাতীর্থস্থান কী? এগুলোকে কেন মহাতীর্থস্থান বলা হয়?

বৌদ্ধ তীর্থস্থান

পাঠ : ২

লুম্বিনী

লুম্বিনী ছিল প্রাচীন কপিলাবস্তু ও দেবসহ নগরীর মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি সুবৃহৎ মনোরম উদ্যান । রানি মহামায়া কপিলাবস্তু থেকে দেবদহ নগরে পিত্রালয়ে যাবার পথে এ উদ্যানে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বব্যাপী এ স্থানের পরিচিতি রয়েছে। বৌদ্ধদের কাছে লুম্বিনী মহাতীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত। লুম্বিনী উদ্যান বর্তমানে রুক্মিনদাই নামে খ্যাত, যা নেপালের বুটল জেলার ভগবানপুর তহসিলের ৩ কিলোমিটার উত্তরে পারিয়া গ্রামে অবস্থিত। সম্রাট অশোক সিদ্ধার্থের জন্মস্থান লুম্বিনী ভ্রমণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। জানা যায়, সম্রাট অশোক তাঁর রাজত্বের বিংশতিতম বর্ষে স্থানটি পরিদর্শন করতে আসেন। তিনি বুদ্ধের জন্মের স্মৃতি বিজড়িত এই পুণ্যস্থানটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং লুম্বিনী ভ্রমণকালে স্তূপটি দেখতে পান। স্তূপের সন্নিকটে শীর্ষদেশে অশ্বমূর্তিযুক্ত একটি প্রস্তরস্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে স্তম্ভটি আবিষ্কৃত হয়। এটি ‘অশোক গুপ্ত' নামে পরিচিত। অশ্বমূর্তি সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগের প্রতীক। স্তম্ভটি পরবর্তীকালে মাঝখানে ভেঙে গেলেও এর গায়ে যে শিলালিপি ছিল তা এখনো বর্তমান। শিলালিপিতে প্রাকৃত ভাষায় এরূপ খোদিত আছে - 'এ স্থানে শাক্যমুনি বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। স্তম্ভের গায়ে খোদিত অন্য অনুশাসনলিপি থেকে আরো জানা যায় যে, সম্রাট অশোক লুম্বিনী উদ্যান দর্শনের স্মারক এবং বুদ্ধের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে এ স্থানকে করমুক্ত করেছিলেন। প্রাচীনকালে এখানে একটি বৃহৎ সঙ্ঘারাম ছিল। কালের গ্রাসে সেটি ধ্বংস হয়ে গেলেও ঐ স্থানে কিছুকাল আগে আর একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিহারের ভেতরে সিদ্ধার্থের জন্মকাহিনী চিত্রিত প্রাচীন একটি পাথরের ফলক আছে। ফলক চিত্রে মায়াদেবী বাম হাতে শালগাছের একটি ডাল ধরে আছেন। পাশে রয়েছে মায়াদেবীর বোন মহাপ্রজাপতি গৌতমী । অন্য পাশে দেবতারা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে নিচে একটি পরের উপর নবজাত সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছেন। বিহারের অনতিদূরে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী স্বরূপ একটি ছোট পুকুর আছে। কথিত আছে যে, সিদ্ধার্থের জন্মের পূর্বে রানি মায়াদেবী এ পুকুরে স্নান করেছিলেন।

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

বর্তমানে এখানে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, জাপানসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশের বিহার ও অতিথিশালা আছে। নেপাল সরকার লুম্বিনীর উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর দর্শনার্থী লুম্বিনী ভ্রমণে আসেন। নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডু থেকে সড়ক পথে লুম্বিনী যাওয়া যায় ।

অনুশীলনমূলক কাজ

লুম্বিনী কেন বিখ্যাত? শিলালিপিতে প্রাকৃত ভাষায় কী লেখা ছিল?

পাঠ : ৩

বুদ্ধগয়া

বুদ্ধগয়া বৌদ্ধদের প্রধান তীর্থস্থান। বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষ মূলে সিদ্ধার্থ গৌতম বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। তিনি যে অশ্বত্থ গাছের নিচে মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন সেই অশ্বত্থ গাছের নাম হয় 'মহাবোধি বৃক্ষ'। যে আসনে বসে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন সেই আসনের নাম 'বজ্রাসন' বা বোধিপালঙ্ক । এ আসনটি একটি অখণ্ড পাথরে নির্মিত। সম্রাট অশোক তাঁর রাজত্বকালে ডীর্থ ভ্রমণে এসে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে বজ্রাসনটি চিহ্নিত করেন। বুদ্ধগয়ায় সেই আসনটি এখনো আছে।

বুদ্ধগয়া মন্দির জগত বিখ্যাত। মন্দিরটি পূর্বমুখী। এটি একটি দ্বিতল ভবন । উপরের তলা থেকে মন্দিরটি ক্রমশ ছোট হয়ে গেছে। মন্দিরের শীর্ষদেশ গোলাকার। মন্দিরের চার কোণায় চারটি ছোট মন্দির আছে। সামনের দুটিতে ওঠার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িতে দুটি পদ্মপাণি বোধিসত্ত্বের মূর্তি অপরূপ শোভা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে আছে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের। দাঁড়ানো মূর্তি। মন্দিরের গায়ে সারিবদ্ধ কুলুঙ্গিতে বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ দেবদেবীর অনেক মূর্তি আছে। এগুলো পাথরে খোদাই করা। মন্দিরের ভেতরে ও বাইরে সারা দেয়ালে অপরূপ কারুকাজ আছে । স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এ মন্দির।

মূল মন্দিরের ভিতরে আছে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বসা বড় বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধাসনে সিংহ ও হস্তীমূর্তি আছে। বাইরে পাঁচটি কক্ষে সারিবদ্ধ পাঁচটি বুদ্ধমূর্তি আছে। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রথম কে প্রতিষ্ঠা করেছেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে পণ্ডিতদের ধারণা, এ মন্দিরটি সম্রাট অশোক, তৎপরবর্তী মিত্রবংশীয় রানি কুরাংগী ও নাগদেবী এবং আরো পরে কৃষাণ বংশীয় ষষ্ঠ রাজা কনিষ্ক প্রমুখের পর্যায়ক্রমিক সহযোগিতা দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং বুদ্ধগয়া ভ্রমণে আসেন। তিনি মন্দিরটির বিবরণ ভ্রমণ বিবরণীতে লিখে রাখেন। তিনি লিখেছেন, মন্দিরটি ১৬০ ফুট উঁচু । এর প্রশস্ত ভূমির উপর বিশটি সিঁড়ির ধাপ বর্তমান । সুবৃহৎ মন্দিরটি ইষ্টক দ্বারা নির্মিত। তিনি এখানে সম্রাট অশোক নির্মিত আরো একটি অলঙ্করণসমৃদ্ধ চৈত্যগৃহ দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।

বৌদ্ধ তীর্থস্থান

মন্দিরের আশে পাশে 'সপ্ত মহাস্থান' অবস্থিত। বুদ্ধত্ব লাভের পর সেসব স্থানে বুদ্ধ সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। এজন্য এ সাতটি স্থান সপ্ত মহাস্থান নামে পরিচিত। সপ্ত মহাস্থান হলো বোধিপালঙ্ক, অনিমেষ চৈত্য, চংক্রমণ চৈত্য, রত্নঘর চৈত্য, অজপাল ন্যাগ্রোধ বৃক্ষ, মুচলিন্স মূল ও রাজায়তন বৃক্ষ। মন্দিরের উত্তর পাশে বুদ্ধের পদচিহ্ন খোদাই করা পাথর আছে। মন্দিরের চারদিকে রয়েছে উঁচু পাথরের প্রাচীর। প্রাচীরের গায়ে বুদ্ধের জীবনের বহু ঘটনা ও জাতকের কাহিনী খোদাই করা আছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর অগণিত মানুষ বুদ্ধগয়ায় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন। বৌদ্ধরা সেখানে মা-বাবা ও পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড-দান করেন। অনেকে শ্রামণ্যধর্মে দীক্ষিত হন। এখানে তীর্থযাত্রীদের থাকার সুব্যবস্থা আছে। মহাবোধি সোসাইটি, বিড়লা মন্দির, সার্কিট হাউজ ইত্যাদিতে তীর্থযাত্রী থাকার সুব্যবস্থা আছে। এছাড়া রয়েছে চিন, আপান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভূটান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধদের নিজস্ব বিহার ও অতিথিশালা। বুদ্ধগয়া মন্দিরের অদূরে একটি জাদুঘর আছে। এখানে বুদ্ধগয়ায় প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুসমূহ সংরক্ষিত আছে।

বুদ্ধগয়া ধন্দির

ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পয়া থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে বুদ্ধপয়া। বুদ্ধগয়া নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অবস্থিত । নৈরঞ্জনার বর্তমান নাম ফল্গু। বুদ্ধ এ স্থানে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। তাই এ স্থানের নাম হয় বুদ্ধগয়া। বুদ্ধগয়া থেকে সড়ক পথে রাজগৃহ নালন্দা প্রভৃতি তীর্থস্থানে যাওয়া যায়।

অনুশীলনমূলক কাজ বুদ্ধগয়া কেন বিখ্যাত?

সপ্ত মহাস্থানের নাম বলো।

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ : 8 সারনাথ

সারনাথ বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসি শহরের অনতিদূরে বরুণা নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাচীনকালে স্থানটি 'ইসিপতন মৃগদাৰ' নামে পরিচিত ছিল। ইতোপূর্বে আমরা ন্যাগ্রোধমূল জাতকে মৃগদাবের বর্ণনা পড়েছি। বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধ এ স্থানে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিকট প্রথম ধর্ম প্রচার করেন। সেদিন ছিল শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। পঞ্চবর্গীয় শিষ্যগণ হলেন : কৌন্ডিন্য, বল্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ। বুদ্ধ এ পাঁচজন শিষ্যের কাছে প্রথম যে ধর্ম দেশনা করেন তা বৌদ্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে 'ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র' নামে পরিচিত। এ সূত্রেই আছে চতুরার্য সত্য এবং দুঃখ মুক্তির সঠিক পথ মধ্যম পন্থা বা 'আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বুদ্ধের প্রথম ধর্ম প্রচারের স্থান হিসেবে সারনাথ মহাতীর্থস্থানের মর্যাদা লাভ করে ।

সারনাথে বুদ্ধ পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের ধর্ম দেশনা করছেন প্রথম ধর্মদেশনা ছাড়াও নানা কারণে সারনাথের গুরুত্ব অপরিসীম। পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের ধর্ম দেশনা করার পর বারানসির শ্রেষ্ঠীপুত্র যশ ও তাঁর চুয়ান্নজন বন্ধুকে বুদ্ধ এ স্থানে প্রব্রজ্যা দিয়েছিলেন। এই একান্নজন, পঞ্চবর্গীয় শিষ্যবৃন্দ এবং আরো চারজনসহ মোট ষাটজন ভিক্ষু নিয়ে প্রথম ভিক্ষুসং প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম বিধিবদ্ধ সঙ্ঘ। বুদ্ধ সর্বপ্রাণীর হিতের জন্য, মঙ্গলের জন্য এই ষাটজন ভিক্ষুকে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর ধর্মবাণী প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন এছাড়া বুদ্ধ এখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দেশনা করেন। সারনাথ বৌদ্ধধর্মের প্রাণকেন্দ্র ছিল। শতশত ভিক্ষু-ভিক্ষুণী এখানে বাস করতেন। ধর্মচক্র প্রবর্তনের স্মারক হিসেবে সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। স্তূপটি পাথরের তৈরি। এর উচ্চতা ছিল ১৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৯৪ ফুট। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং স্তূপটি দেখেছিলেন । এখানে বৌদ্ধ তীৰ্থস্থান

১১৭

একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। সারনাথের ধ্বংসস্তূপে বৌদ্ধযুগের অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখানে ৮৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আরো একটি স্তূপ দেখা যায়। এটি 'চৌখণ্ডি স্তূপ নামে পরিচিত। পণ্ডিতগণ ধারণা করেন, পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের সঙ্গে বুদ্ধের এখানেই প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তারই স্মারক হিসেবে স্তূপটি নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া ৭১ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট বেলে পাথরের একটি স্তম্ভ আছে । স্তম্ভটির মাথায় চার মুখ বিশিষ্ট সিংহমূর্তি আছে। তার উপর একটি ধর্মচক্র আছে। চক্রটি সাম্য, মৈত্রী, শান্তি ও প্রগতির প্রতীকরূপে ভারতীয় জাতীয় পতাকায় স্থান পেরেছে। স্তম্ভটি ভেঙে যাওয়ার সিংহমূর্তিটি সারনাথের সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। মৃগদাবের অদুরে 'ধামে স্তূপ' দেখা যায়। এতে বুদ্ধের দেহধাতু ছিল বলে ধারণা করা হয়। স্তূপটির চারদিকে বাঁধানো চত্বর আছে। সেখানে তীর্থযাত্রীরা ঘুরে ঘুরে ত্রিরত্নের নাম স্মরণ করেন ।

সারনাথের বৌদ্ধ পুরাকীর্তি

এখানে মূলগন্ধকুটির বিহার নামে একটি সুবৃহৎ বিহার ছিল। ভগবান বুদ্ধ যে কুটিরটিতে বাস করতেন তাকে গন্ধকুটির বলা হয়। হিউয়েন সাং বিহারটি ১০০ ফুট উচ্চ বলে বর্ণনা করেছেন। বিহারটি শৈল্পিক কারুকার্য খচিত ইষ্টক দ্বারা নির্মিত ছিল। তিনি এ বিহারে দেড় হাজার ভিক্ষুকে বসবাস করতে দেখেন। ভারতের মহাবোধি সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা অনাগারিক ধর্মপালের প্রচেষ্টায় বিহারটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এখানে বুদ্ধের দেহধাতু আছে যা বছরে একবার জনসাধারণকে দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। কথিত আছে যে, এখানে 'সন্ধম্মচক্রজিন' নামে একটি সুবৃহৎ সঙ্ঘারাম ছিল। এখানে একটি বোধিবৃক্ষের নিচে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের উপদেশরত বুদ্ধের মূর্তি আছে। দূর থেকে দেখতে বুদ্ধ ও তাঁর পাঁচ শিষ্যকে জীবন্ত বলে মনে হয় ।

সারনাথে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার অনন্য নিদর্শন বহু বিহার, সঙ্ঘারাম, স্তূপ ও স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এখানে ধর্মচক্র মুদ্রায় উপবিষ্ট একটি বুদ্ধমূর্তিও পাওয়া গেছে। এগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

অপরিসীম। বারানসির রেলস্টেশন থেকে সড়ক পথে সারনাথ যাওয়া যায়। এছাড়া সারনাথের

কাছেও একটি রেলস্টেশন আছে। এখানে তীর্থযাত্রীদের জন্য ধর্মশালা ও সরকারি অতিথিশালা আছে।

অনুশীলনমূলক কা

পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নাম বলো। সারনাথে কি কি বৌদ্ধ নিদর্শন রয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি করো।

পাঠ : ৫ কুশীনগর

কুশীনগর বৌদ্ধদের অন্যতম পবিত্র তীর্থভূমি। এখানে গৌতম বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। প্রাচীনকালে কুশীনগর বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন, কুশীনারা, কুশীগ্রাম, কৃপাবর্তী ইত্যাদি। ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার কোশিয়া নামক স্থানে এটি অবস্থিত। এটি বৌদ্ধদের চার মহাতীর্থস্থানের অন্যতম। প্রাচীনকালে কুশীনগর হিরণ্যবর্তীর পশ্চিম তীরে ছিল। তখন এটি মন্ত্র রাজ্যের রাজধানী ছিল ।

কুশীনগর

কুশীনগরের অনতিদূরে পাবা। পাবার এক ধনী পুত্র ছন্দ গৌতম বুদ্ধকে প্রথম দেখেই স্রোতাপত্তি ফল লাভ করেছিলেন। তিনি তাঁর নিজের আমবাগানে বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধকে দান করেছিলেন। পরিনির্বাণের আগের দিন যুদ্ধ সেখানে পৌঁছলে চুন্দ তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সে সময় বুদ্ধ চুলের ঘরে আহার করেন। এটিই তাঁর শেষ জাহার। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বৌদ্ধ তীর্থস্থান

সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। অন্তিম শয্যায় বুদ্ধ পরিব্রাজক সুভদ্রকে দীক্ষা দেন। সুভদ্র ছিলেন বুদ্ধের শেষ শিষ্য। তারপর তিনি ভিক্ষুদের উদ্দেশে শেষ উপদেশ দান করেন। ভিক্ষুদের শেষ উপদেশ স্বরূপ তিনি বলেছিলেন, 'ভিক্ষুগণ! সমস্ত সংস্কার অনিত্য, ক্ষয়শীল। তোমরা অপ্রমাদের সাথে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন কর। অতঃপর তিনি মন্ত্রদের জোড়া শালগাছের নিচে অন্তিম শয্যায় শায়িত অবস্থায় বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের সময় হরিবল নামক এক বৌদ্ধ দাতা এখানে দীর্ঘ ২২ হাত লম্বা একটি শায়িত বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেন । এটি এখনো তীর্থযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর পাশে একটি বড় স্তূপ আছে। এর মধ্যে একটি 'পরিনির্বাণ তাম্রপট' নামে তামার পাত দেখা যায়। সম্রাট অশোক এই স্থান পরিদর্শন করে বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থান নির্দিষ্ট করেন। চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন কুশীনগর ভ্রমণ করেন। তিনি এখানে লোকবসতি বেশি দেখেননি বলে লিখে গেছেন।

উত্তর ভারতের গোরক্ষপুর রেলস্টেশন থেকে সড়ক পথে কুশীনগর যাওয়া যায়। এখানে যাত্রীদের জন্য অতিথিশালা আছে। বুদ্ধগয়া, সারনাথ, কুশীনগর ও লুম্বিনী এই চার মহাতীর্থে সড়ক পথে যাওয়া যায়। বাংলাদেশ থেকে বহু তীর্থযাত্রী বাসে করে দল বেঁধে চার মহাতীর্থস্থান দেখতে যান।

অনুশীলনমূলক কাজ

বুদ্ধ শেষ উপদেশ স্বরূপ কী বলেছিলেন? বুদ্ধের শেষ শিষ্য কে ছিলেন?

পাঠ : ৬

বৌদ্ধ তীর্থস্থানের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব

ধর্মীয় আব

তীর্থস্থানসমূহের সঙ্গে বুদ্ধ, তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্য এবং অনেক বরেণ্য মনীষীর স্মৃতি জড়িত আছে। তীর্থস্থান ভ্রমণের ফলে তাঁদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তাঁদের আদর্শ জীবন ও কর্ম মানুষকে নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। তীর্থস্থান ভ্রমণ পুণ্যের কাজ। বিশেষত লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ, কুশিনগর প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করলে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা মানসপটে জাগ্রত হয়। এতে মন অনাবিল আনন্দে ভরে যায়। বিক্ষিপ্ত চিত্ত সংযত হয়, উদারতা বাড়ে, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে। অকুশল কর্ম হতে বিরত থেকে কুশল কর্ম সম্পাদনে মন উৎসাহিত হয়। মৈত্রী, করুণা, সহনশীলতা এবং পরোপকারী মনোভাব সৃষ্টি হয়। তাই বলা যায়, তীর্থস্থানের ধর্মীয় গুরুত্ব

অপরিসীম

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

তীর্থস্থান অতীত ইতিহাসের অনন্য সাক্ষী। তাই তীর্থস্থান ভ্রমণে ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। বৌদ্ধ তীর্থস্থানসমূহ শুধু বৌদ্ধ ধর্মীয় নয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনারও প্রামাণ্য দলিল। বুদ্ধ এবং প্রাচীনকালের রাজন্যবর্গ, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্ম-দর্শনের নানা ঘটনা তীর্থস্থানসমূহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন, বৌদ্ধতীর্থ সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সঙ্গীতিতে মহাকশ্যপ স্থবিরের নেতৃত্বে এবং পাঁচশত পণ্ডিত অর্থৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বুদ্ধবাণী সংগৃহীত হয়েছিল। জানা যায়, রাজা অজাতশত্রু প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সুতরাং সপ্তপর্ণী গুহা ভ্রমণে ত্রিপিটক সংকলনের ইতিহাস জানা যায়। লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ, কুশিনগরের ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, রাজা বিম্বিসার, অজাতশত্রু, প্রসেনজিত এবং শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিক প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিগণ বৌদ্ধধর্মের প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাছাড়া আরো জানা যায়, বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ, প্রথম ধর্ম প্রচার এবং মহাপরিনির্বাণ লাভের স্থানসমূহকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সম্রাট অশোক এসব স্থানে স্তূপ, স্তম্ভ, বিহার ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। এসব স্তূপ, স্তম্ভে লিপিবদ্ধ অনুশাসন থেকে সম্রাট অশোকের শাসন প্রণালি, ধর্মীয় ও প্রজা কল্যাণমূলক নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা যায়। পণ্ডিতগণ প্রাচীন তীর্থস্থানগুলোকে অতীতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গণ্য করেন। প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলো শুধু ধর্ম নয়, নানা শাস্ত্রের শিক্ষাকেন্দ্রও ছিল। বুদ্ধ শিষ্যরা ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি জ্যোতিষশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, গণিতশাস্ত্র, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদিও শিক্ষা দিতেন। তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, ময়নামতি, পাহাড়পুর প্রভৃতি প্রাচীন যুগের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এ শিক্ষাকেন্দ্র গুলোর ইতিহাস পাঠে প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ও বিহারজীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তাই বলা যায় তীর্থস্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব

তীর্থস্থানসমূহে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে। যেমন, বিভিন্ন তীর্থস্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে বিহারের অবকাঠামো, স্তূপ, স্তম্ভ, ভিক্ষুদের ব্যবহারের দ্রব্যসামগ্রী, বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব ও বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামাটি ও পাথরের চিত্রফলক, অনুশাসনলিপি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নসামগ্রী হতে প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। যেমন: অলঙ্কৃত ইষ্টক দ্বারা নির্মিত বিহারের অবকাঠামোতে সে যুগের উন্নত নির্মাণ শৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত মূর্তিগুলো মূল্যবান পাথরে নিখুঁতভাবে নির্মিত, যা প্রাচীনকালের উন্নত ভাস্কর্য শিল্পের স্বাক্ষর বহন করে। চিত্রফলকগুলোতে তৎকালীন ধর্মীয় ও সমাজজীবনের নানা কাহিনী অঙ্কিত আছে। স্তূপ ও স্তম্ভ শীর্ষে স্থাপিত অশ্ব ও সিংহ মূর্তিগুলোতে অপরূপ শৈল্পিক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে। এসব বিবেচনা করে বলা যায়, তীর্থস্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম।

Content added || updated By
Promotion